আজ, বুধবার | ৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | রাত ১২:৫৭

ব্রেকিং নিউজ :
মাগুরা সদর ও শ্রীপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন উপজেলা চেয়ারম্যান পদে মাগুরা সদরে রানা ও শ্রীপুরে রাজনের দিকেই সবার নজর মাগুরায় ঋষিপাড়ার সদস্যদের মধ্যে কৃষিব্যাংকের সহজশর্তে ঋণ বিতরণ মাগুরায় রানাকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন ছাড়লেন ভিপি জাহাঙ্গীর শ্রীপুরে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী রাজন-সংগ্রামের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ জমে উঠেছে শ্রীপুর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন মাগুরায় জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস উদযাপন বৃষ্টির প্রার্থনায় নামাজ পড়ে কাঁদলেন শ্রীপুরের মুসল্লিরা মহম্মদপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় শিক্ষকের মৃত্যু মাগুরায় প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ

অনন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক নাম ‘তোরাব স্যার’

জাহিদ রহমান : ১১ সেপ্টেম্বর চির বিদায় নিয়ে পরপারে চলে গেলেন আমাদের সবার প্রিয় শিক্ষক এম তোরাব আলী। অনন্ত ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় যিনি ‘তোরাব স্যার’ নামেই আমাদের কাছে চির নমস্য।

সেদিন সকালে তাঁর মৃত্যুসংবাদে অনেকের মতো আমার হ্নদয়ও কেঁদে উঠে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে স্যারের মৃত্যুসংবাদটা প্রথমে জানতে পারি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই। ফেসবুকে আলোকিত জুয়েলের স্ট্যাটস থেকে নিশ্চিত হই স্যার আর বেঁচে নেই। অকস্মাত্ স্যারের মৃত্যু সংবাদে খানিকটা নিস্তব্ধ হয়ে পড়ি। চোখের সামনে ভেসে উঠে স্যারের সাথে স্কুল জীবনের নানান স্মৃতি। অন্তচক্ষু দিয়ে দেখতে পাই উচ্চকিত কন্ঠস্বর, বিশুদ্ধ উচ্চারণ আর পরিচ্ছন্ন পোশাকের সেই অনন্য মানুষটিকে।

শ্রীপুর মহেষ চন্দ্র পাইলট স্কুলের নিচতলার শ্রেণীকক্ষে স্যার আমাদের পড়াচ্ছেন। কখনও কখনও দরজা দিয়ে উঁকি দিচ্ছেন শান্ত কুমার নদের দিকে। এক বুক স্নিগ্ধ নিঃশ্বাস নিয়ে ইংরেজি কবিতা আওড়াচ্ছেন। পুরো ক্লাসে পিনপত্তন নীরবতা। আমরা মুগ্ধ হয়ে স্যারের পড়া শুনছি। বই-এর পাতা উল্টে উল্টে স্যার ক্লাসরুমে হাঁটছেন। কখনও কখনও বাম হাতের চকচকে ঘড়িটা ঠিক করে নিচ্ছেন।

আমরা সব ভাইবোনই এই প্রিয় শিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করেছি। বলবো তাঁর অন্তহীন ভালোবাসার কারণেই আমরা ভাইবোনেরা দেশের বড় বিদ্যাপীঠে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। প্রিয় তোরাব স্যার এবং আমার পিতা আবার স্কুলের সহপাঠীও ছিলেন। দুজনে এক সঙ্গে স্কুলে পড়তেন। সে কারণে স্যার আমাদের একটু বেশিই ভালোবাসতেন। আমার বড় ভাই প্রফেসর আলমগীর রহমান স্যারের যে প্রিয় এক ছাত্র তা বলাই বাহুল্য। আলমগীর রহমানকে তিনি নিত্য স্মরণ করতেন হয়ত একই পেশার কারণে।

ভাবতে থাকি জীবনে যতোটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি সেখানে নিভৃতচারী প্রিয় স্যারের কতো না ছায়া-মায়া, আদর-ভালোবাসা লেগে আছে। আমাদের বেড়ে উঠার পেছনে রয়েছে তাঁর অনন্য অসামান্য অবদান। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে একটানা দশম শ্রেণী পর্যন্ত তাঁকে শিক্ষক ও অভিভাবক হিসেবে পাই।

৭৭ সালে আমরা যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই তখন তিনি স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক। সে সময় প্রধান শিক্ষক হিসেবে ছিলেন আরেক প্রিয়শিক্ষক দৃঢ়চেতা মানুষ শ্রদ্ধেয় আব্দুর রহিম জোয়ার্দ্দার। আব্দুর রহিম জোয়ার্দ্দার স্যার চলে যাওয়ার পর ৭৮ সালে তোরাব স্যার প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। সহযোদ্ধো হিসেবে তিনি পাশে পান জোয়ার্দ্দার আবুল হাশেম (সারঙ্গদিয়া), শিক্ষক আব্দুল কুদ্দুস (চর গোয়ালপাড়া), মো. শফিউদ্দিন (গয়েশপুর), শচীন্দ্রনাথ বিশ্বাস (খামারপাড়া), কাজী আব্দুল কুদ্দুস (বরিশাট), নিমাই পাল (শ্রীপুর), মোতাহার হোসেন (মীনগ্রাম), পরিমল চন্দ্র (বরালদহ)সহ আরো অনেককে।

৮২ সালে আমাদের ব্যাচ মেট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। সে বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় আমাদের ব্যাচ মাগুরা মহকুমায় বেশ ভাল ফলাফল করে। ৮২ সালে আমরা যারা মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রত্না (শ্রীপুর), নার্গিস (শ্রীকোল), আনোয়ারা (মদনপুর), রেনু (হরিন্দী), ফেরদৌসি (মদনপুর), দীপু (সারঙ্গদিয়া), মুক্তি (গোয়ালপাড়া), রচনা (সারঙ্গদিয়া), মিঠু (সারঙ্গদিয়া), রোকেয়া (চন্দ্রপাড়া), পান্না (বারইপাড়া), রবিউল (বাখেরা), আলম (হরিন্দী), বড় কালাম (খড়িবাড়িয়া), পিকুল (হরিন্দী), আকমল (সারঙ্গদিয়া), সাঈদ (শ্রীপুর), মিছরুল (চরগোয়ালপাড়া), কালাম (চরগোয়ালপাড়া), আছাদ (জোকা), হাসান আইয়ুব (সারঙ্গদিয়া), আশফাক (মীনগ্রাম), ফয়েজ (হোগলডাঙ্গ), তাছের (জোকা), হক (জোকা), জুমমা (সারঙ্গদিয়া), অশোক (শ্রীপুর), কামরুল (জোকা), মোমরেজ (চন্ডীখালি), নওয়াব (সাবিনগর), মফিজ (কাজলী), অলোক (বারইপাড়া), রেবা (কাজলী), নাসিমা (সারঙ্গদিয়া), জোছনা (সারঙ্গদিয়া), প্রদীপ (সারঙ্গদিয়া), পরিতোষ (বরিশাট), কালাম-হাই (হোগলডাঙ্গা), রফিকুল (বরিশাট), গাজী (গোয়ালপাড়া), প্রকাশ (গোয়ালপাড়া), শাহাদত (গোয়ালপাড়া)সহ আরো অনেকে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল করে। পাশের হার বেশি হওয়ায় স্যার অনেক খুশি হন।

যদ্দুর মনে পড়ে আমাদের সময়ে শ্রীপুর মহেষচন্দ্র হ্ইাস্কুলের সাথে ‘পাইলট’ শব্দটি যোগ হয়। মনে আছে সে সময় ভাল ফলাফলের পাশাপাশি স্কুলের মর্যাদা এবং সম্মানকে জাতীয়ভাবে তুলে ধরতে স্যার অনেকগুলো সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করেন। স্কুল আঙিনায় বৃক্ষরোপণ, শ্রেণীকক্ষে মাসিকভিত্তিতে বিতর্ক চালু করা, দেওয়াল পত্রিকা বের করা, গল্পের বই নিয়মিত পড়া-এসব কিছু হতে থাকে তাঁর সুন্দর তদারকিতে। একই সাথে প্রতিটি শিক্ষার্থীর মাঝে শক্তিশালী নৈতিকতা তৈরি, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতেও তিনি স্বচেষ্ট থাকেন।

শিক্ষক হিসেবে ‘তোরাব স্যার’ বরাবরই ছিলেন এক আদর্শ শিক্ষকের প্রতিচ্ছবি। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, সুন্দর পাঠদান, পরিপাটি পোশাক-পরিচ্ছদ, সুন্দর সাবলীল উচ্চারণ ও ভাষা প্রয়োগ, সততা-এসব মিলিয়ে তিনি ছিলেন এক অনুপম ব্যক্তিত্বের অধিকারী। স্বভাবতই তিনি হতে পেরেছিলেন সবার প্রিয় এক আদর্শবান শিক্ষক। পরিপূর্ণ একজন শিক্ষক বলতে যা বুঝায় তিনি সেটাই ছিলেন। নির্বিবাদেই বলতে হয় বাংলাদেশের যেকোনো বড় বা নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়ার সবটুকু যোগ্যতা তাঁর ভেতরে ছিল। কিন্তু তিনি কখনই শ্রীপুরের প্রিয় মহেষচন্দ্র পাইলট উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আ¤্রবৃক্ষ শোভিত সবুজ আঙিনা আর প্রিয় কুমার নদের মায়া ছেড়ে চলে যেতে চাননি।

আর তাই শিক্ষকতা জীবনের শেষ দিনটি কাটিয়েছেন তিনি এই স্কুলেই। আজকে শ্রীপুর মহেষচন্দ্র পাইলট হাইস্কুল যে উচ্চমাত্রায় আসীন সেখানে তাঁর অবদান অসামান্য। প্রধান শিক্ষক থাকা অবস্থায় স্কুলের উন্নয়ন, আর ভালো ফলাফলের বাইরে স্যার যেনো কিছুই ভাবতেন না। নিজের খ্যাতি নিয়ে চিন্তা করতেন না। শুধুই ভাবতেন যশোর বোর্ডে স্কুলের মার্যাদাকে আরও কত উপরে তোলা যায়।

১৯৯৩ সালের কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। আমাদের মাষ্টার্স পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। রেজাল্টের অপেক্ষায় আছি। কিছুদিনের মধ্যেই হল ত্যাগ করে চলে যাবো। মুহসিন হলের ৬০৭ নাম্বার কক্ষের সাথে বিচ্ছেদ ঘটতে শুরু করেছে। প্রিয় এই কক্ষে অনেকদিন ধরে আমার বসবাস। মাগুরার অনেক গ্রামের তরুণদের নিয়মিত আনাগোণা আমার রুমে। অনেকেরই রাত্রিযাপনের আপন ঠিকানা। কেউ আসে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। কেউ চাকরির খোঁজে। আবার এখানে থেকেই কেউ কেউ অন্যান্য কলেজে যাওয়া-আসা করে। পরীক্ষা শেষ করার পরপরই আমি জনপ্রিয় একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করি। অফিস রাজমণি সিনেমা হলের সামনের এক বিল্ডিং-এ। হঠাত্ একদিন সকালে আমার কক্ষে এসে হাজির আমার প্রিয় শিক্ষক এম তোরাব আলী। বড় ছেলে পলাশকে সাথে নিয়ে এসেছেন। স্যারের হাতে স্কুলের বিবিধ কাগজপত্র সাজানো একটা ফাইল। আমি বিস্মিত! স্যার আমার হলে এসেছেন। স্যার এত কষ্ট করে কেন এসেছেন? বললেন কোনো এক সূত্র থেকে খবর পেয়েছেন সাচিলাপুর সম্মিলিনী উচ্চবিদ্যালয় সরকারিকরণ হচ্ছে। কিন্তু তিনি মনে করেন এর আগে সব বিবেচনায় তাঁর স্কুল শ্রীপুর মহেষচন্দ্র পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় সরকারিকরণের যোগ্যতা রাখে। স্যারের সব কথা শোনার পর বললাম, উপজেলা সদরের স্কুল হওয়ায় আপনার স্কুলই অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। এর আগে বোধ হয় অন্য কোনোটাও হওয়ার সম্ভাবনা নেই। স্যারের কাছ থেকে সব তথ্য নিয়ে আমি কয়েকটি পত্রিকায় রিপোর্ট করা ব্যবস্থা করলাম। নিজেও লিখলাম বিভিন্ন সাপ্তাহিক পত্রিকায়।

স্যার বরাবরই সাহিত্যনুরাগী ছিলেন। ভাষাজ্ঞান তাঁর ছিল প্রখর। আবার শুদ্ধ ভাষায় চমত্কার বক্তব্য দিতে পারতেন। সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখিও করতেন। তিনি প্রচুর বই পড়তেন। ছিলেন অনুসন্ধানী। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল নিয়েও তাঁর উত্সাহ ছিল সবসময়। কবি কাজী কাদের নেওয়াজকে তিনি ভীষণরকম ভালোবাসতেন। ৮৩ সালে কবি কাজী কাদের নেওয়াজ মারা যান। ৮৫ সালে আমরা কবি কাদের নেওয়াজ স্মরণে একটি স্মরণসভার আয়োজন করি শ্রীপুর ডিগ্রী কলেজে। স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন তোরাব স্যার। শ্রীপুর ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক বাবু দুর্গাপ্রসাদ মজুমদারসহ অনেকেই সেখানে বক্তব্য রাখেন। পুরো অনুষ্ঠান সমš^য় করেন হরিন্দীর তোহা ভাই।

মনে আছে ৮৬ সালে আমার সম্পাদনায় শ্রীপুর থেকে ‘নির্ঝর’ নামে একটি লিটিল ম্যাগাজিন বের করি। ম্যাগাজিনটি বের করার কথা শুনে স্যার আমাকে খুবই উৎসাহিত করেন। ম্যাগাজিনে স্যার নিজেও শিক্ষা উন্নয়ন বিষয়ক একটি লেখাও দেন। বছর দুই আগে তিনি অধিনায়ক আকবর হোসেনে উপর একটি লেখা পাঠান আমার কাছে। সে লেখাটি স্বযতনে রেখেছি। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে চাই, মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনানী অধিনায়ক আকবর হোসেন তোরাব স্যারকে বরাবরই খুব পছন্দ করতেন।

‘তোরাব স্যার’ -যতদিন বেঁচে থেকেছেন ততদিনই সুন্দরের পক্ষে কথা বলেছেন। বিশুদ্ধ মানবিক মানুষ তৈরির জন্য নিরবে কাজ করেছেন। তিনি সফলও হয়েছেন। তাঁর হাতে গড়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই আজ দেশ ও দেশের বাইরে বরেণ্য ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তবে তাঁর মতো গুনীজনকে যে এ সমাজ সঠিকভাবে মূল্যায়িত করতে পারেনি এটাও সত্য। সেটা করতে পারলে কোনো ব্যক্তি নয়, আমাদের সমাজই বেশি লাভবান হতো। তবুও তিনি যে নৈতিকতা ও আদর্শের পথ দেখিয়ে গেছেন তা এ প্রজন্মের কাছে অবশ্যই মহামূল্যবান। আলোকিত, আদর্শবান, পরিপূর্ণ এক শিক্ষকের অনন্য উদাহরণ হয়েই ‘তোরাব স্যার’ সবার মাঝে বেঁচে থাকবেন ।

জাহিদ রহমান: সম্পাদক, মাগুরা প্রতিদিন ডটকম

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology